Tuesday, 31 March 2015

জি পিএস রিডিংএ ( কিছু) বিভ্রাট :

জিপিএস - এ কো-অরডিনেট বেশ একুরেট দেখালেও উচ্চতা প্রায়ই পুরাপুরি ঠিক দেখায় না । তাই বিশ্বের পাহাড় - পর্বত মাপার ক্ষেত্রে কখনই এটার উপর পুরোপুরি নির্ভর করা হয় না । বিশেষ করে সঠিক উচ্চতা মাপার ক্ষেত্রে এটা বেশ 'কম নির্ভরযোগ্য' একটা উপায় । তবে এতে করে মোটামুটি উচ্চতা সম্পর্কে বেশ ভাল একটা ধারণা পাওয়া যায় । 

জিপিএস এ কোন স্হানে যাওয়ার পর রিডিং স্ট্যাবেল হতেও বেশ খানিকটা সময় নেয় । আর স্ট্যাবেল অবস্হায়-ও কিছুটা উঠা নামা করে । এই অবস্হার একটা লম্বা সময় রিডিং দেখলে প্রকৃত উচ্চতার একাট ধারণা পাওয়া যায় । এই রিডিং গুলো সবিস্তারে আবার গিপিএক্স ফাইলে সংরক্ষিত থাকে । সেটাকে টেক্সট হিসেবে পড়ে নিলে কিছু ডেটা আপনি এমনিতেই বাদ দিটে পারবেন । যেমন যেসব ডেটা স্টাবেল ডেটা থেকে খুব বেশী ফ্লাকচুয়েট করছে । সেগুলো । একটা ভাল স্ট্যাটিসটিকাল প্রসেস খুব নির্ভরযোগ্য ফলাফল নিয়ে আসটে পারবে । 

উচ্চতা মাপার জন্য সঠিক ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে ত্রিকোনমিত্রিক পদ্ধতি । আমাদের দেশের পাহাড় মাপা-মাপির জন্য যা খুব দরকার হয়ে পরেছে । তবে এগুলোর যন্ত্রপাতিগুলো বেশ দামী । ট্রেকার - ট্রাভেলারদের হাতে আপাতত নেই । তাই জিপিএস ডিভাইসগুলোই এখন শেষ ভরষা । 

এগুলো কি আসলেই কোন কাজের না ? এগুলো তাহলে ব্যবহার হয় কেন ? আসল কথা হচ্ছে এগুলো খুবই কাজের , তবে উচ্চতা মাপার কাজটা এর মুল কাজ না । এ থেকে খুবই সঠিক ভাবে আপনি অক্ষাংশ - দ্রাঘিমাংশ জানতে পারবেন , আর তা দিয়ে অচেনা পথে নিজেই পথ বের করে চলতে পারবেন। আপনার আগে কেউ কোন স্হানে গেলে তার কো-অর্ডিনেট জানা থাকলে - আপনি-ও সে জায়গায় পৌছে নিশ্চত হতে পারবেন একই স্হানে পৌছেছেন কি না । 

তাই কোন পিকের সামিট এভিডেন্স হিসেবে এটা খুবই কাজের একটা জিনিষ । এছাড়া ১০০ ভাগ সঠিক উচ্চতা নে মেপেও কোন পাহাড়টা কার থেকে উচু বা নীচু সেটা বলে দেওয়া যায় । যেমন সাকাহা ফং দেশের একমাত্র পাহাড় যেখানে ৩৪০০ ফুটের বেশী রিডিং আসে । কেওক্রডং তাজিংডং - এ এগুলোর রিডিং কয়েকশ ফুট কম আসে। তাই নিশ্চত ভাবেই বলে দেওয়া যায় 'সাকা' কেও - তাজিং থেকে উচু ।
  সাকাহাফং - এ প্রথমবার আমি জিপিএস নিয়ে যাইনি । দ্বিতীয় বার ভ্রমণ বাংলাদেশের একটা জিপিএস ছিল । যার রিডিং ছিল ১০৫০ মিটার বা ৩৪৪৫ ফুট । সাকাতে অন্যান্য দল ৩৪৫০ - ৬০ এমনকি ৩৪৮০ ফুট রিডিং ও পেয়েছে । জিপিএস রিডিং - এ এতটুকু পার্থক্য হ্তে পারে, হয়েও থাকে । সাকাতে আমার কাছে আরেকটা জিপিএস ছিল সেটার রিডিং ছিল মাত্র ৩৪১২ ফুট ! যাই হোক এতগুলো ভুল -ঠিক রিডিং মিলিয়ে বলা যায় সাকাহাফং ৩২২০ -৮০ ফুট বা প্রায় ৩৪৫০ ফুটের মত ।লেখক বলেছেন: জ -ত্লং - এ আমি রিডিং পাই ৩৩২৮ থেকে ৩৮ ফুটের মাঝে । গড়ে ৩৩৩২-৩ ফুট । এর মাঝে একটা ছবি আমি রেখেছি ৩৩২৮ ফুটের । বাকি রিডিংগুলো জিপিএক্স ফাইলে সংরক্ষিত আছে । ফাইলটা এডভেন্চারবিডি ও বাংলাট্রেকে শেয়ার করেছি। কেউ চাইলে দেখে নিতে পারেন । আমার সংগী একরাম - ৩৩৩০ ফুট রিডিং এর ছবি রেখেছে . দুমলং এর সামিট লেটারে দেখা যায় নেচার এডভেন্চার ক্লাব রিডিং পায় ৩৩১২ ফুট। কিন্তু দ্বিতীয় দলের জিপিএস রিডিং অনেক কম ছিল । আমি শুরুতে ৩৩০৩-৪ ফুট পাই । গাইড মালিরাম বলল আরো একটু দূরে একটা জায়গা আছে আরো দশ ফুট উচু হবে । কেটেকুটে সেখানে গিয়ে পেলাম ৩৩১৫ ফুট ! কিন্তু আগের জায়গায় ফিরে এসে পেলাম এবার ৩৩২৩-৪ ফুট । আর চোখের দেখাটেও দ্বিতীয় জায়গাটাকে বেশী উচু মনে হল না । বড় জোড় সমান হতে পারে । জিপিএক্স ফাইলের রিডিং দেখে আলম ভাই ও বললেন দ্বিতীয় জায়গাটা উচু মনে হয় না ।



বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু সাত পাহাড়ের সাতকাহন :৬ষ্ঠ চুড়া মাইথাইজমা


 
কেওক্রাডং এর চুড়া থেকে মাইথাইজমা , মেঘ চুম্বন করছে পাহাড় চুড়া কে । 

একবছর ধরে বাংলাদেশের উচু চুড়াগুলো বেয়ে উঠা আর মেপে দেখার কাজ করতে করতে একসময় বুঝলাম শারীরিক - মানষিক সব ভাবেই একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেছি। মনে মনে ১০ -১২ টা পিক সামিট + রিডিং নেবার ইচ্ছা থাকলেও সেটাকে ৭ এ থামিয়ে দিলাম । আর ৭ টি চুড়ার সবগুলো মাপতে গিয়ে শেষটা ছিল এই মাইথাইজমা । ৬ষ্ঠ চুড়া । মজার ব্যাপার অন্যান্য চুড়ার তুলনায় এটার পথ ঘাট বেরও হয়েছিল অনেক দেরীতে । শীর্ষ সাতটি চুড়ার সবকয়টিতে আমার আগে আর কোন ট্রেকার যায় নি, তাই একটা কথিত 'রেকর্ডের' হাত ছানিও ছিল মনে মনে । তবে যেটা সবচেয়ে বেশী চাইছিলাম মিশনটা শেষ করতে । আমি আসলেই ক্লান্ত ও বিদ্ধস্ত ছিলাম । টাকা- পয়সাও ধার দেনা হয়েছে অনেক টা । সবমিলিয়ে আমি একটু সস্তি চাইছিলাম, একটু বিশ্রাম চাইছিলাম । ঘরে বসে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চাইছিলাম। 

আমি এতটাই মরিয়া হয়েগিয়েছিলাম যে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম এইবার যদি মাইথাইজমা সামিট না হয়, তবে ৬ষ্ঠ চুড়াকে বাদদিয়েই প্রথম পাচটা চুড়ার সামিট রিডিং দিয়ে একটা ঘোষণা দিয়ে দিব, " কেওক্রাডং বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু চুড়া না, তাজিংডং ও না" । যদিও এটা নিয়ে অনেক আগেই বেশ কিছু পোষ্ট দিয়েছিলাম, কিন্তু এবারের ঘোষণাটা হত " আমি নিজে মেপে দেখেছি পাচটা চুড়া " - এরকম প্রত্যক্ষ 
সাক্ষ্য নির্ভর । যাই হোক ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলতে হবে, মনে মনে যা চাইছিলাম , সাতটি চুড়া মেপে তবেই ঘোষণা দিব সেটারই সুযোগ হল । 
 
কেওক্রাডং - তাজিংডং ট্রেইল থেকে তোলা : দূরে দুই মাথা ওয়ালা পাহাড়টা দুমলং ( বাংলাদেশে তৃতীয় ), আর তার ডানে দেখা যাচ্ছে ৬ষ্ঠ চুড়া মাইথাইজমা । 

নভেম্বরে দুমলং ( পাশের পাহাড়টা, বাংলাদেশর তৃতীয় ) সামিটের সময়-ই ইচ্ছা ছিল একবারে দুইটা পাহাড়-ই সামিট করব । কিন্তু এবার ( ২০১৪ তে) বর্ষার অনেক পরেও যথেষ্ট বৃষ্টি হয়েছে বান্দরবন এলাকায় । শীতকালে জংগল শুকিয়ে ঝোপ ঝাড় একদম কমে যায় - সেটা হওয়ার কোন নাম নিশাণাও ছিল না নভেম্বরে । বর্ষ শেষ হয়েছে আদৌ মনে হচ্ছিল না দুমলং চড়ার সময় । মাইথাইজমার গা বেয়েছিল ঘন ছনের জংগল । গাইড মালিরাম - বাহাদুর কারবারী কেউই সাহষ দিলানা । বলে দিল ঝানুয়ারীটে আসতে জনংল কমে যাবে । 

 
পুকুর পাড়া পাস থেকে তোলা সকালের ছবি, মেঘের উপর মাইথাইজমা ( উচুটা ) একটু বামে তিসা/তুইসা ক্লমা। 

ট্রেকিং রুট : রুমাবাজার থেকে বগালেক বা বগা মুখ হয়ে যেতে হবে পুকুর পাড়া ।সেখানে অনিন্দ সুন্দর রাইখান লেকের দুই ধারে দুইটা গ্রাম, পুকুর পাড়া আর পাংজং পাড়া । যেকোন একটায় থাকলেই হবে ।সেখান থেকে সোজা পুবে রাইখাং নদী পার হয়ে মাইথাই এর রাস্তা । 

 

এই লেকের পাশ দিয়েই যেতে হয় মাই থাই জমা । লেকের এক পাশে পুকুর পাড়া আর্মি ক্যাম্প : 


কালের ডাইরী থেকে : বাংলাদেশের ৪র্থ সর্বোচ্চ চুড়া কংদুক বা যোগী পাহাড় আরোহণের ইতিহাস ।

 
কংদুক বা যোগী পাহাড় সামিটের উদ্দেশ্যে : লোহ ঝিরি ধরে ট্রেকিং, দলিয়ান পাড়ার পথে । 

যোগী পাহাড় আর মদক রেঞ্জের আশে-পাশের চুড়াগুলোতে আমার চোখ আটকে যায় প্রথমবার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়া 'মদক তং' বা 'সাকা হাফং' সামিট করার পরপর-ই। সাকা সামিটে করে দক্ষিণে যাবার সময় খাড়া দেওয়ালের মত চুড়া থেকে কোন ভাবেই চোখ সরাতে পারছিলাম না । সাজাই পাড়া থেকে রেমাক্রি যাবার পথে বেশ কয়বার স্হহানীয় গ্রামবাসীদের কাছে এই চুড়াগুলো সম্পর্কে জানতে চাই। চুড়াগুলো নিয়ে বিভিন্ন মিথও শুনতে পাই সে সময় । লোকেরা বলছিল ঐ পাহাড় উঠলে মানুষ বাচে না। ঢাকা থেকে এসে একটা দল উঠেছিল কিন্তু তারা বাচেনি, যাবার পথে এক্সিডেন্টে মারা যায় । যোগী পাহাড়ে প্রথম যারা অভিযান করেছিল ফিরতি পথে তাদের এক্সিডেন্ট হয় সেটা সত্য, অভিযাত্রী দলের দুই জন সদস্য ডা: মুগ্ধ আর সুজন মৃত্যু বরণ করে সেটাও সত্য - তবে দলের বাকী সদস্য মাইনুল আর সালেহিন মর্মান্তিক ভাবে আহত হয়ে বেচে যায় সেটাও সত্য ! আর যা থেকে এটাও প্রমাণ হয় একশভাগ মৃত্যু নিশ্চিত - এমন কোন কথা প্রমাণিত নয় । 

যাই হোক পাহাড় চড়ার মরণ নেশা মাথায় চেপে বসলে বাচাতেই হবে এজাতীয় ফন্দি- ফিকির খুব একটা জায়গা পায় না । আর২০১৪র এপ্রিলে জও-ত্লং সামিটের পর মদক রেঞ্জের একমাত্র আকর্ষণ বা মোহাবিষ্টতার অনুঘটক হয়ে দাড়ায় এই যোগী পাহাড় । যোগী নামটা ত্রিপুরা গোষ্ঠীর দেওয়া, যার অর্থ বাতাস। যোগী পাহাড়কে ত্রিপুরারা বলে যোগী হাফং বা বাতাসের পাহাড় । স্হনীয় মারমা ও বোমদের দেওয়া নামও নাম আছে । একটা নাম হচ্ছে কংদুক । সম্ভবত নামটা মারমাদের দেওয়া । বোমরা ওদের ভাষায় এটাকে ডাকে নেড়া পাহাড় । আমাদের অভিযাণের সময় আমারা বেশ কিছু গাছ-পালা পেলেও আগে এই পাহাড়ের চুড়াটি ছিল একদম নেড়া । ত্রিপুরাদের 'বাতাস' আর বোমদের 'নেড়া' এই দুই নাম থেকে যেটা বুঝা যায় তীব্র বাতাস আর পাথুরে ভুমির কারণে এখানে গাছ-পালা কিছু হত না । 

 

প্রথম অভিযাত্রী দলের প্রয়াত সদস্য মুগ্ধর স্বপ্ন ছিল নাইখ্যামুখ থেকে শুরু করে নাইখ্যাঝিরির শেষ পর্যন্ত এক্সপ্লোর করার । যার গন্তব্য শেষপর্যন্ত কংদুক বা যোগী পাহাড়ে - ঝিরির উৎসমুখে । আর পাহাড়ী ঝিরির স্হানে স্হানে অনেক গভীর 'খুম' বা গভীর জায়গা থাকে যেগুলো পার হওয়া ভেলা ছাড়া সম্ভব নয় । আর এই ভেলা তৈরীর জন্য পাহাড় বেয়ে প্রয়োজণীয় গাছ/বাশ কাটাও একটা সময় সাপেক্ষ ও খুবই কষ্টকর একটা কাজ। তাই মুগ্ধদের অভিযানে প্রচুর শ্রম আর সময় চলে যায় মুল ঝিরির রাস্তা ধরে পথ চলতেই। পরিকল্পনা মাফিক ঝিরি পথ শেষ করে কংদুকের শেষ মাথায় তারা যখন পৌছে তখন স্হানীয়রা পাহাড়ে উঠার বিষয়ে কেউই কোন স হযোগিতা করতে সম্মত হয়নি । দলের সদস্য মাইনুল বলেছিল যে সেখানেও এরকম জনশ্রতি ছিল যে এি পাহাড়ে উঠলে মানুষ মারা যায়, ফিয়ে আসে না । 
 
বাংলাদেশের অভিযানের ইতিহাসের সবচেয়ে অনবদ্য এই অভিযাত্রায় দলের সদস্যরা কোন প্রকার স্হানীয়দের সাহায্য সহযোগিতা না নিয়ে সব রকম বাধা-বিঘ্ন আর উপেক্ষা করে , নিজেরাই এগিয়ে যায় সামিটের পথে । চুড়ায় পৌছতে পৌছতে সন্ধা নেমে আসে । পর্বতের শীর্ষেই রাত কাটিয়ে দেয় এই অদম্য অভিযাত্রী দল। একটা কঠিন অজানা এবং ভয়াবহ রকমরে খাড়া পথে ধরে নেমে আসে দলের সদস্যরা। পরের ইতিহাসটা খুবই করুণ আর মর্মস্পর্শী । ভয়াবহ দূর্গটনায় মারা যায় মুগ্ধ আর সুজন। আহত হয়ে দিনের পর দিন হাসপাতালের বিছানায় কাটিয়েছিল মাইনুল আর সালেহীন। আর যোগীতে কোন দলের অভিযানও বন্ধ ছিল প্রায় আড়াই বছর । 

কংদুক বা যোগী পাহাড়ের কিছু কিছু জায়গা একেবারেই খাড়া আর সেখানে কোন গাছপালাও হয়না । আর এই নেড়া যায়গাটা কতটা খাড়া তা গুগুল আর্থ দেখে বুঝাও যায় না । আর এখানেই ভুল বুঝে সহজতর একটা চুড়া মনে করে ২০১৪র অক্টোবরে আমি আর সাদেক হোসেন রওনা দেই সামিটের উদ্দেশ্যে । সাদেক হোসেন সনি আমাদের দেশের একজন শক্তিশালী ও সম্ভবনাময় পর্বতারোহী । ভারতের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং এসোসিয়েশনের বেসিক ও এডভান্স কোর্স ছাড়াও এভারেষ্টের কাছে কালাপাথার এলাকায় ১৮০০০ ফুট পর্যন্ত ট্রেকিংএর অভিজ্ঞতার অধিকারী সনি । 

 

যোগীর খাড়া দেয়ালের পাশ বেয়ে উপরে উঠছে নওশাদ( ছবিতে লাল দাগ দিয়ে চিন্হিত করা ) 

(চলবে) 


বাংলাদেশের শীর্ষ সাতটি পর্বতশৃংগ জরিপ, কেওক্রাডং ৪র্থ !

কেওক্রাডং বা তাজিংডং কোনটাই যে দেশের শীর্ষ চুড়া না , সেটা ইউএস টপোগ্রাফিক ম্যাপ আর রাশান টপো ম্যাপে দেখা যায় বেশ কয়েক বছর আগেই। তবে এই ম্যাপগুলো উন্মুক্ত হলেও সহজলভ্য ছিল না। তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লবের যুগে ইন্টারনেটের অভাবিত বিস্তারে সবাই বেশী করে একসেস পায় - এজাতীয় তথ্য আর মানচিত্রে।  

তবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা এই পাহাড়গুলোর ব্যাপক পরিচিত বিস্তার লাভ করে গুগুল আর্থ সফটঅয়্যার উন্মুক্ত হওয়ার পর পরই । বিশ্বের তাবৎ অলি-গলির খোজ খবর ঘরে বসে এত নিখুত আর নির্ভরযোগ্য ভাবে পাবার আর কোন উপকরণ পৃথিবীর ইতিহাসে নেই । গুগুল আর্থ ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে - এই আলোচনাও জোড়দার হল কেওক্রাডং বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় না! তাজিংডং ও না!! ব্লগে ফোরামে এটা নিয়ে গবেষণা শুরু হলেও সবার আগে স্বশশীরে অভিযান পরিচালনা করেন বৃটিশ অভিযাত্রী জিনজেফুলেন। আর তিনি প্রায় ডজন খানেক স্যাটেলাইটের সাথে সংযুক্ত জিপিএস ডিভাইস দিয়ে মেপেও দেশের সর্বোচ্চ চুড়া মদক তং বা মদকমুয়াল নিশ্চত করেন । আর ফুলেনের পর পরই দেশের অভিযাত্রী আর ট্রেকারদের মাঝে এক করকম বিপ্লব _ই ঘটে যায় বলতে হবে - সেখানে যেতে থাকে শত কিংবা হাজার - হাজারে । বই পত্র আর ম্যাপে এর নাম মদক তং হলেও ট্রেকারদের মাঝে এটা পরিচিত পায় 'সাকাহাফং' নামে । 

অবাক হবার বিষয় - উচু পাহাড়টি এত স্পষ্টভাবে চিন্হিত হবার পরও সরকারী নথিপত্রে এটি লিপিবদ্ধ হয়নি । আর সবচেয়ে উচুটি খুজে পাবার পর শত শত ট্রেকার ব্যাস্ত হয়ে পর এর পরের শীর্ষ চুড়াগুলো অনুসন্ধানের জন্য । তাদের অনুসন্ধান আর কিছু উপকরণ( US 1:250K Topographic Map (United States Topographic Maps), Russian 1:200K Topographic Map, SRTM data (Shuttle Radar Topography Mission : NASA), ASTER (Advanced Space Borne Thermal Emission and Reflection Radiometer) and Google Earth ) সবগুলোতেই দেখা যায় কেওক্রাডং বা তাজিংডং উচু না । সেই সাথে চিন্হিত হয় দেশের শীর্ষচুরাগুলো অনেক আগেই । 

তবে এ বিষয়ের যাবতীয় উদ্দ্যোগ-ই ছিল ব্যক্তি পর্যায়ের কিংবা বিচ্ছিন্ন অথবা কোন একক সংগঠনরে পক্ষ থেকে । যথাযথ অনুসন্ধানের মাধ্যমে র্শীষ পর্বত শৃংগগুলোর সুস্পষ্ট অবস্হান ও উচ্চতা জানা ও তা প্রকাশ করা ছিল সংশ্লিষ্ট সকলেরই ঐকান্তিক কামনা । সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই এ বিষয়ে দেশের অভিজ্ঞ একটি সংগঠন “ভ্রমণ বাংলাদেশ” এবং অনলাইন ফোরাম “এডভেঞ্চারবিডি” একটি সমন্বিত উদ্দ্যোগ গ্রহণ করে। উচ্চতা পরিমাপে শীর্ষ চুড়াগুলোর উচ্ছতা পাওয়া যায় : 
১। মদক তং বা সাকাহাফং ১০৫০ মিটার / ৩৪৪৫ ফুট 
২। জ-ত্লং ১০১৪. মিটার / ৩৩২৮ ফুট 
৩। দুমলং ১০১০ মিটার / ৩৩১৫ ফুট 
৪। কেওক্রাডং ৯৮৫ মিটার / ৩২৩০ফুট 
৫। কংদুক বা যোগীহাফং ৯৮৩ মিটার / ৩২২২ ফুট 
৬। মাই-থাইজমা ৯৬৯ মিটার / ৩১৭৯ ফুট 
৭। লুকু ত্লাং বা থিন্দলতে ৯৫৭ মিটার /৩১৩৯ ফুট 

এডভেঞ্চারবিডির রাতুলবিডি প্রতিটি চুড়ায় উপস্হিত থেকে জিপিএস রিডিং সংগ্রহ করেন ও এর ছবি তুলেন । সর্বোচ্চ পর্বত সাকা সহ অত্যন্ত কঠিন ও বিপদ সংকুল জ-ত্লং ও যোগীহাফং চুড়ায় আরোহনে সাহায্য করেছেন একরামুল হায়দার । এছাড়া দলিয়ান পাড়া ( যোগী ) ও পুকুর পাড়া ( মাইথািজমা ) অভিযানে সহায়তা করেন সাদেক হোসেন সনি । জরিপ ও তার ফলাফল প্রকাশে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন ভ্রমণ বাংলাডেশের সভাপতি টুটু ভাই, সাধারণ সম্পাদক মনা ও ইকো ট্রাভেলার্স এর আবু বকর। 

 
কেওক্রাডং থেকে তাজিংডং যাবার পাথে দক্ষিন-পূবে দেখা যায় মদকতং বা সাকাহাফং, দেশের সবচেয়ে উচু চুড়া । 


 
কেওক্রাডং এর জিপিএস রিডিং 


 
২য় সর্বোচ্চ জ-ত্লং ( ৩৩২৮ ফুট) 

 
কনদুক বা যোগী পাহাড়ের ২৯০০ ফুট উচু থেকে দেখা জ-ত্লং। 

 
লোহ ঝিরি থেকে জত্লং ,দেশের সবচেয়ে কঠিন বিবেচনা করা হয় এই চুড়া আরোহন । 

৩য় : দুমলং 
 
লম্বক্র -তিন্দলতে রেন্জের পুকুর 'পাড়া পাস' থেকে তোলা দুমলংএর ছবি । 


 
ডান পাশে পিছনের পিকটা দুমলং এর মেইন সামিট । সামনে বামের টা দুমলং ওয়েষ্ট - একটা সাবসিডিয়ারী পিক, মেইন পিক না ।

বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু সাত পাহাড়ের সাতকাহন : ৭ম চুড়া লুকুডং বা থিনদলতে ।


থিনদলতে পাড়া থেকে চুড়ায় যাবার সময় এরকম একটা ভিউ পাওয়া যায় থিনদলতে পাহাড় বা লুকু ডং এর । থিনদলতে - একটা গাছের নাম । ছোট ছোট পাতা । প্রথম যখন পাড়া প্রতিষ্ঠিত হয় এখানে, বর্তমান কারবারীর বাবার আমলে, ছোট ছোটা পাতার এই গাছটি প্রচুর পরিমানে ছিল এখানে। আর থিনদলতে গাছের নাম অনুসারে এই পাড়ার নামও হয়ে যায় থিন্দলতে পাড়া । 

বান্দরবন - রাঙামাটির সীমানা ধরে মাথা উচুকরে দাড়িয়ে থাকা ৩০০০ ফুটের লম্বক্র - থিন্দলতে রেঞ্জ, দু-দুটি প্রমিনেন্ট ৩০০০ ফুটের পিক আছে এটাতে । আর কম প্রমিনেন্স এর এক বা একাধিক সাবসিডিয়ারী পিকও আছে এটাতে । এ হিসেবে ট্রেকারদের কাচে বেশ আকর্ষণীয় এই অঞ্চলটি । এর সবচেয়ে উচু চুড়াটি দেশের সপ্তম চুড়া, উচ্চতা হিসেবে। আশে পাশের পাড়ার লোকেরা একে ডাকে 'লুকু' নামে, লুকুডং । তবে থিনদলতে পাড়ার লোকেরা একে থিনদলতে ত্ল্যাং নামেও ডাকে আবার লুকুডং ও বলে । 

থিনদলতে পাড়া থেকে সামিট পর্যন্ত আমাদের গাইড ছিল পাড়ার কারবারী , তার ঘরেই আমরা ছিলাম রাতের বেলা । একটা জায়গায় গিয়ে সে আমাদের বলল এটাই চুড়া , আমাদের আগে আসা বিডি-এক্সপ্লোরারের ফাহিম - এর সামিট বোতল খোজ করলাম । গাইড বলল জুমে আগুন ডেওয়াতে সব পুড়ে গেছে । আমারা রিডিং পেয়েছিলাম ৩১২০ ফুটের মত । কিন্তু সেটা ছিল আসল রিডিং থেকে বেশ কিছুটা কম । ভোর সকালেই ফাহিমকে কল দিলাম ওর ঘুম নষ্ট করে। বেচার আমাডের রিডিং শুনে অবাকই হল । আশা পাশের ভিউ জানতে চাইল । আমরা ঘন মেঘের কারণে একটু দূরের কিছুও দেখতে পাচ্ছিলাম না! 


শেষ পর্যন্ত ফাহিম এসএম এস করে ওর সামিটের কো-অর্ডিনেট জানাল । ল্যাটিচিউড দেখলাম আমাদের থেকে কম । শেষ তিন ডিজিট আমাদের ছিল ৬২০, আর ওর ৬১১ ! মানে আরো দক্ষিণে যেতে হবে । পাহাড়ে এই সমস্যাটা খুবই প্রকট - তৈরী ট্রেইল না থাকলে গাইডরা প্রায় ই একটা সুবিধাজনক জায়গায় নিয়েই সামিট দাবী করা বসবে । যোগী/ কনদুকেও একই কাজ করেছিল । যাইহোক দক্ষিণে এগুতেই দেখলাম নেমে যাচ্ছে , তাও এগিয়ে গেলাম । একটু এগিয়ে গেলে দেখলাম সামনে একটা উচু যায়গা দেখা যাচ্ছে । আমি চেচিয়ে উঠলাম ঐ যে সামিট ! এরপরের পথটা ছিল সহজ, প্রায় সমতল জায়গায় হালকা বাশ ঝাড় ঠেলে এগিয়ে যাওয়া । আমারা রিডিং পেয়েছিলাম ৩১৩৯ থেকে ৪১ ফুট । ইট্রেক্স সামিট জিপিএস এ । 
 

সামিটে গিয়ে আগের টিমের সামিট বোতল খুজতে গিয়ে কিছুটা খুড়ে ফেললাম, একটা বোতলও পেলাম , আর সেটাতে পেলাম ফাহিমের চিঠিও ! 
 

কিভাবে যাবেন : প্রথমেই বান্দরবন থেকে বাসে করে চলে যাবেন রুমা বাজার । সেখানে গাইড ঠিক করে তাকে নিয়ে আর্মি ক্যাম্প ও থানায় রিপোর্ট করতে হবে । সেখান থেকে পায়ে হেটে/চাদের গাড়ী করে বগা লেক। বগা লেক থাকে কেওক্রাডং ৩ ঘন্টার পথ । কেওক্রাডং দুভাবে যাওয়া যায় থিনদলতে পাড়া । কেওক্রাডং থেকে পুবদিকে নেমে গেলে সুংসাং পাড়া, দেড়/দুই ঘন্টার পথ । আর বেশ কিছুটা দক্ষিনে গিয়ে পূব দিকে নেমে গেলে থাইক্কং পাড়া তিন ঘন্টার পথ। সুংসাং পাড়া বা থাইক্কং পাড়া দুজায়গা দিয়েই যেতে পারবেন থিনদলতে পাড়া , ৪/৫ কিংবা ৬ ঘন্টার পথ । 
আর থিনদলতে পাড়া থেকে চুড়া মাত্র ঘন্টাখানেকের পথ । 

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০০০ ফুটের -ও বেশী উচ্চতায় থিনদলতে পাড়া, যাবার সময় সোজা পশ্চিমে দেখা যায় মজার পাহাড় কপিতাল, একেবারে টেবিলের মত দেখতে , মাথাটা সমান করে কাটা ! 
 
কপিতাল : ইষ্ট ফেস। 

আমরা যাওয়ার সময় গিয়েছিলাম থাইক্কং পাড়া দিয়ে । সেখান ঠেকে সোজা নীচে প্রায় হাজার ফুটের বেশী নেমে গেলে রেমাক্রি খাল ( আসলে নদী, ক্যানেল বা খাল মানব সৃষ্ট হয় ) রেমাক্রী মুলত সাংগু নদীর একটা উপনদী । কোন নদী চলার পথে ভাগ হয়ে গেলে সেটাকে বলে শাখা নদী , আর নদী চলার পথে অন্য কোন নদী এসে মিশলে সেটাকে বলে উপনদী। রেমাক্রী খাল(!) অনেকটা পথগ পেরিয়ে দক্ষিণে রেমাক্রী বাজারের কাছে গিয়ে সাংগুতে পতিত হয়েছে। রেমাক্রির প্রতি কোন ফেসিনেশন বা মোহ থাকলে এই পথে যেয়ে দেখতে পারেন। ঘন গাছ-গাছালি ঢাকা রেমাক্রি নদীর হাটু জল বা আরো কম পনিতে নেমে একে নিয়ে চলা অনেক অনেক অভিযানের কাহিনী, আশে পাশের ভু-বৈচিত্র মনে থাকলে কিছুটা আবেগ তাড়িত হতেই পারেন । 

ফিরতি পথে আমার নিয়েছিলাম সুংসাং পাড়ার ট্রেইল । সেটাতে রেমাক্রি পার হতে হয় না , তবে রেমাক্রীতে পতিত হওয়া ছোট ছোট ঝিরি পার হয়ে যেটে হয় । আশে পাশে ঝিরি গুলোতে বেশ কিছু ঝরণাও আছে, ক্লান্তি আর সময়ের চাপ থাকায় সেগুলো দেখার চেষ্টা করিনি। তবে রেমাক্ড়ির সমন্তরাল চলার সময় দূরে নীচে দেখা পেলাম ত্লাবং বা জোড়া ঝরনা যেটাকে অনেকেই হালে 'ডাবল ফলস' বলে (!)  

এক্সপ্লোর করার ইতিহাস :বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধান করে যতটুকু জানতে পেরেছি ২০০৮ এর দিকে নেচার এডভেঞ্চার আর নর্থ আলপাইনের অভিযাত্রীরা একটা যৌথ অভিযান পরিচালণা করে দেশের প্রায় ১৬টি শীর্ষ চুড়া অনুসন্ধান বা আরোহনের উদ্দেশ্যে ।। প্রবীণ ট্রেকার শ্রদ্ধেয় হক ভাই -এর বর্ননা অনুসারে দুই দলের পক্ষথেকে অন্যান্যদের মধ্যে আজিজ ও রাফা ছিল সে অভিযানে ।এর পর ফাহিম (অামার জানামতে তিনিই আমাদের দেশেরসবচেয়ে বেশী পিক প্রথম পরিমাপ করেন) এটি পরিমাপ করেন ও সামিট লেটার রেখে আসেন । পরবর্তী সময় ট্রাভেলারস অব বাংলাদেশের জাকিউও এটি আরোহন করেন । তবে বাংলা ট্রেকে জাকিউলের পোষ্ট করা তথ্য অনুসারে তাদের তাদের লেটিচিউড এর মিনিট ছিল ৫৪.৬২৬ , যেটা মুল সামিট থেকে বেশ কিছুটা দূরে। 
 


এর আগে একটা পোষ্ট-এ লিখেছিলাম দেশের সাতটি সর্বোচ্চ চুড়ায় গিয়ে মাপামাপির ঘোষণা ।বাংলাদেশের শীর্ষ সাতটি পর্বতশৃংগ জরিপ, কেওক্রাডং ৪র্থ ! এখন ভাবছি সাতটি পাহাড়ের -ই কিছু কিছু বর্ণনা আর আমাদের অভিযানের কিছু কাহিনী সবার সাথে শেয়ার করব ।

Sunday, 29 March 2015

কেওক্রাডং বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু পাহাড় না! তাজিংডং বাংলাদেশের উঁচু দশটি পাহাড়ের মাঝেও নেই ! !

কেওক্রাডং বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু পাহাড় না! তবে উঁচু পাহাড় কোনটি? এটা কি তাজিংডং? না সেটিও না, তাজিংডং বাংলাদেশের উঁচু দশটি পাহাড়ের মাঝেও নেই ! তবে বাংলাদেশের উচু পাহাড় কোনটি ? উচু পাহাড়টা মাপার উপায় কি ? আচ্ছা মানলাম এটা উচু পাহাড়, কিন্তু এর চেয়ে যে উচু পাহাড় নেই তার প্রমাণ কি?

বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু পাহাড় বান্দরবন জেলার দক্ষিনে মায়ানমার সীমান্তে। প্রাচীন ম্যাপগুলোতে এর নাম মদলত্ল্যাং (Modol tuang): আর বর্তমানে ট্র্যাকারদের কাছে সাকাহাফং নামে বেশ পরিচিতি পেয়েছে।

পাহাড়ের উচ্চতা মাপার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। আধুনিক কালে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে এর উচ্চতা মাপা হয়। এগুলো অনেক বেশী সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য দেয়। আর স্যাটেলাইটের প্রযুক্তিতে এগিয়ে আছে আমেরিকা-রাশিয়া। আমেরিকার নাসা থেকে প্রকাশিত ভৌগলিক তথ্যে দেখা যায় বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু স্হান কেওকাড়াডং না, বরবগ এর থেকে দক্ষিন-পুবে মায়ানমার সীমান্তে । একই ভাবে রাশিয়ান স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ডেটাও বলে একই কথা ।

২০০০ -২০০৫/৬ এর দিকে বাংলাদেশের উচু পাহাড় কোনটা – এটা নিয়ে বেশ কথা হত, মতামত আসত। তখন এটা নি্যে উইকিতে বেশ আলোচনাও হত । এই সব আলোচনায় রেফারেন্স হিসেবে দেওয়া হত আমেরিকা- রাশিয়ার স্যাটেলাইট ও SRTM ডেটার কথা । SRTM ডেটাতে দেখা যেতো “কেও” বাংলার উচু চুড়া না, বরং মায়ানমার সীমান্তের একটি বিশেষ স্হানই উচু। ভৌগলিক অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশে জায়গাটা নির্দিষ্ট ছিল, কিন্ত এর নাম পরিচয় বিস্তারিত মানুষের জানা ছিল না।

অবশ্য স্যাটেলাইট ডেটার সাথে খুবই অল্প লোক পরিচিত ছিল, আর এই ডেটা কিভাবে পাঠোদ্ধার করতে হয় তাও বেশীর ভাগ মানুষের কাছে অজানা ছিল। তাই স্যাটেলাইট ডেটায় “কেওক্রাডং” উচু না, এটা লোকের বলাবলি করত, কিন্তু এথেকে খুব স্পষ্টভাবে কিছু প্রমাণ করে দেবার সামর্থ তখন আমাদের ছিল না। পাশাপাশি সময় গুগুল আর্থ জনপ্রিয় হতে থাকে, আর লোক-জনও বাংলাদেশের উচু পাহাড়টার খোজ করতে থাকে! আর যার ফলে বাংলাদেশের “সবচেয়ে উচু” জায়গাটা তখন চিহ্নিত হয়ে যায়, আর কেউ তা দেখতে চাইলে তা গুগুল আর্থে দেখানও সম্ভব হয়।

এসব ছিল স্যটেলাইট ডেটার হিসাব নিকাশ। হাতে কলমে কোন সরাসরি মাপ নেওয়ার তথ্য তখনও আমাদের কাছে ছিল না! এ বিষয়ে প্রথম যিনি তিনি হচ্ছেন ব্রিটিশ অভিযাত্রী Ginge Fullenhttp://www.gingefullen.com/gingefullen.html ফুলেন সাহেব মিশন নিয়েছেন বিশ্বের তাবৎ দেশের সবচেয়ে উচু চুড়াগুলোতে উঠবেন! বিশাল কষ্টসাধ্য প্রায় অসম্ভব একটা মিশন। আর সেই মিশনের ধারাবাহিকতায় তিনি হাজির হন বাংলাদেশ!

SRTM ডেটা ওপর ভিত্তি করে, GPS হাতে করে তিনি স্বশরিরে খুজে বের করেন আমাদের দেশের সবচেয়ে উচু চুড়াটা! তার সাথে গাইড ছিলেন পাহাড়ি বোম সম্প্রদায়ের মাষ্টার ” লাল ময়”। এর আগেই তিনি প্রায় শতাধিক দেশের সর্বোচ্চ চুড়া ছুয়ে ফেলেছেন, তার সাথে তার মুকুটে যোগ হল আরেকটি পালক! ফুলেন সহেব বলেন “My successful attempt to achieve a World Record to climb the highest peak in all 47 countries in Europe – a record” 

ফুলেনের অভিযান পত্র-পত্রিকায় এলে এই পাহাড় নিয়ে ব্যাপক সারা পড়ে, আর আগ থেকেই সচেষ্ট বিভিন্ন এডভেন্চার ক্লাবও পেয়ে যায় সেখানে যাবার খুব স্পষট দিক নির্দেশনা! যাই হোক বাংলাদেশের ট্রেকিং দল গুলোর মধ্যে ” ইয়াহিয়া খান ” সাহেব একদল তরুণ ট্রেকার নিয়ে এই পাহাড় চড়েন সম্ভবত ২০০৮ -এ, ফুলেনের পরের বছর। আর তার দুদিন বাদে এটাতে উঠতে সক্ষম হন নেচার-এডভেন্চার দলের সদস্যরা । আর এরপর প্রতিবছরই সেখানে যাবার ধারাবাহিকতা চলতে থাকে এডভেন্চার প্রেমিকদের মাঝে।

ফুলেনের অভিযানসহ আরও বহু অভিযাণের প্রাপ্ত GPS ডেটায় দেখা গেল এটি কেওকাড়াডং থেকে অনেক উঁচু (প্রায় ২০০ ফুট), আর এর উচ্চতা ৩৪০০ ফুটের চেয়েও বেশী! 



উপরের ছবিটি Lyngve Skrede এর অভিযানে তোলা। তিনি জানুয়ারী ২০১১ তে সেখানে সফর করেন: আর একটা মজার বিষয় হচ্ছে Lyngve Skrede আর Ginge Fullen এটাকে মদক মুয়াল নামেই চিনেন!
Click This Link

নীচের ছবিটি ইয়াহিয়া খান সাহেবের অভিযানের সময়ের, ছবিটি সজল খালেদ প্রকাশ করেছেন বিডিনিউজ - এ



উপরের ছবিটি Lyngve Skrede এর অভিযানে তোলা। তিনি জানুয়ারী ২০১১ তে সেখানে সফর করেন: আর একটা মজার বিষয় হচ্ছে Lyngve Skrede আর Ginge Fullen এটাকে মদক মুয়াল নামেই চিনেন!

Click This Link


এরপর বিভিন্ন দল সেখানে গিয়ে এর উচ্চতা মেপেছে,( নেচার এডভেন্চার, ডি-ওয়ে :http://www.facebook.com/dway.expeditors , বাংলাট্রেক, আরো অনেক ), আর সেই সাথে মাপা হয় “কেও” এর উচ্চতাও । আর এভাবেই প্রমান হয় কেওকড়াডং বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু পাহাড় নয় এটা হচ্ছে মদক মুয়াল/ ত্লাং বা সাকাহাফং ।

আর “কেওক্রাডং ” এর উপরের ফলকেও লেখা আছে এটা ৩১৭২ ফুট ।

আর এই উচ্চতা গুলো আর্মির সার্ভে যন্ত্রপাতির সাহায্যে মাপা এবং খুবই সঠিক মাপ দেয়।

অন্যদিকে 1:250,000 US Army Topographic (Series U502, U.S. Army Map Service, 1955) and 1:200,000 Soviet Military Topographic map. – এতে দেখা যায় মদকের চুড়াটি ৩৪৫৪ ফিট এটাও GPS ডেটার সাথে খুবই মিলে ।


পাহাড়ের খোজ খবর নিতে বেশ আগ্রহী হয়ে ২০০৬ এ google earth – এ জায়গাটা চিহ্নিত করে একটা পাবলিক মার্ক -ও বসিয়েছিলাম । পরবর্তীতে এই জায়গাটায় google earth – আরো অনেকগুলো মার্ক পড়ে । আর এ থেকেও আপনি নিশ্চত হতে পারবেন যে হাজার হাজার google earth ইউজারদের কাছে, এই স্হানটি -ই সবচেয়ে উচু।

For the US and Rashan Maps please visit : http://www.banglatrek.org/?page_id=64

এত কিছুর পরও তর্কের খাতিরে কেউ বলতে পারে, বুঝলাম জায়গাটা ৩৪০০ ফুটের বেশী উচু, আর মানলামও এটি কেওক্রাডং থেকে উচু, কিন্তু এর থেকে উচু চুড়াও তো বাংলাদেশে থাকতে পারে ! কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন এটাই বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে উচু ?

এর বেশ কয়েকটি জবাব আছে । প্রথমে আসবে টপোগ্রফিক ম্যাপ। বিশ্ব ব্যাপী এটি ব্যবহার হয় পাহাড় পর্বত আর উচা নিচা জায়গার মাপ বের করার জন্য । আর বাংলাদেশের টপোগ্রফিক ম্যাপ পাবেন আপনি maps.googe.com – এ।

বাংলাদেশের টপোগ্রাফিক মাপ দেখলেও আপনার কাছে খুব সহজেই পরিষ্কার হবে যে মায়ানমার সীমান্ত – এবং বিশেষ করে মদকের ঐ চূড়াটাই দেশের সবচেয়ে উচু স্হান। সারা দেশে আর কোন ষ্হানই এরূপ উচু না!

আর একটি জবার হচ্ছে বড় বড় চূড়াগুলো বিক্ষিপ্ত ভাবে যেখানে সেখানে থাকে না । এগুলো সারিবদ্ধ ভাবে থাকে এক একটি মাউন্টেন রেন্জ – এ। আর বাংলাদেশের ৩০০০ ফুটের চেয়ে উচু রেন্জের সংখাও নির্দিষ্ট । আর এই কয়টা রেন্জ ধরে আপনি গুগুল আর্থ দেখলেই পেয়ে যাবেন উচু চুড়া গুলো!

উপরের পদ্ধতি দুটো হচ্ছে আপনি নিজের চোখে যখন খুজতে যাবেন। আর তা না করে আপনি স্যাটেলাইট ডেটা ডাউনলোড করেই পেয়ে যেতে পারেন পাহাড়ের চৌদ্দ গুষ্টির খবর ।

মদক টং/টুয়াং বা সাকাহাফং যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পিক তা নিম্নের সবগুলো উপায়ে মিলিয়ে দেখা হয়েছে:

১ । US 1:250K Topo Map
২। Russian 1:200K topo Map
৩। SRTM data
৪। ASTER (Advanced Spaceborne Thermal Emission and Reflection Radiometer)
৫। Google Earth
৬। Data Recoarded by trekkers using
৭। handheld GPS receiver.

এছাড়াও maps.google.com – E টপগ্রফিক ম্যাপ আসে, কনটোর লাইন দেখা যায়, সেখানেও উচু একটা জায়গাই দেখা যায়। বিস্তারিত রেফারেন্স এর জন্য ” বাংলাট্রেক” এর সাইট ভিজিট করুন। http://www.banglatrek.org/

এবার আসুন আলোচনা করি, তথাকথিত সরকারি সর্বোচ্চ তাজিংডং নিয়ে : তাজিংডং এর উচ্চতা ৮৭১ মিটার, ঠেলে ঠুলে ২৮৫৬ ফুট হবে! সুত্র : Click This Link

আর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তিনটি চুড়া : 
মদকতুং/সাকাহাফং ৩৪৮০ ফুট (১০৬২ মিটার ),কোন কোন সুত্রে ৩৪৫৪ ফুট।
দ্বিতীয় জত্লং ৩৩৪৮ ফুট ( ১০২১ মিটার) 
তৃতীয় দুমলং ৩৩০৬ ফুট (১০০৮ মিটার ) 

এছাড়া ৩০০০ ফুটের পাহাড় আছে : 

সিপ্পি ৩০১৬ফুট ( ৯১৯ মিটার ) 
কপিতাল ৩০৮৩ ফুট (৯৪০ মিটার) 
তিনমুখ পিক ৩১০০ফুট (৯৪৫ মিটার ) 
থাইক্যাং ও তিনদলতে পাড়ার পুব দিকের একটি পাহাড় লম্বক্র রেন্জে ৩০৬৭ ফুট। 

আর এ কয়টি ছাড়াও ৯০০ মিটার পিক আছে, যেগুলো ৩০০০ ফুট না 

ক্রিসতুং ৯০৮মিটার
ফনথুসিপ/নাগ পাহাড় 
থানচি যাবার পথে মেরুয়া পাড়ার কাছের পাহাড় ( পশ্চিম দিকে) আর এ বিষয়ে খুব নির্ভরযোগ্য তথ্য পাবেন : http://www.banglatrek.org/ তে